ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

নীরবতাটুকু থাক : ফিল্ম সমালোচনা: "ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট (১৯৮৮)

সাম্যদীপ সাহা July 18, 2020 at 9:57 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

পরিচালকঃ থিওডোরস অ্যাঞ্জেলোপোলস
গল্পকারঃ থিও অ্যাঞ্জেলোপোলস, টোনিনো গেরা
সঙ্গীতঃ এলেনি কারাইন্ড্রু
চিত্রগ্রহণঃ গিওরগস কারভান্তিস

"Angelopoulos is a great master...A powerful film with startling imagery" - Martin Scorsese.

বিবিসি-এর একটি সর্বকালের সেরা একশোটি বিদেশী (নন্-ইংলিশ্) চলচ্চিত্রের তালিকা আছে, প্রখ্যাত গ্রিক চলচ্চিত্র নির্দেশক থিওডোরস অ্যাঞ্জেলোপোলস পরিচালিত “Landscape In The Mist” (১৯৮৮) সেই তালিকায় শততম সংযোজন। এই সিনেমা এক সফরের কথা বলে, এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখায়। তাতে সামিল হয় এগারো বছরের বালিকা ভউলা এবং তার ছোট্টো ভাই আলেকজান্দ্রোস। এই দুই অকুতোভয় ভাইবোন গ্রিস থেকে জার্মানির অজানা পথে চলেছে তাদের বাবাকে খুঁজতে, একাই। নিঃসঙ্গ এই যাত্রার উদ্দেশ্য স্পষ্ট, কিন্তু অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছনো অনিশ্চিত। চলার পথে কখনো টিকিট না থাকায় তাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়, কখনো তারা ট্রাকে চড়ে বসে, কখনো ক্ষুদ্র পদক্ষেপে পথ হাঁটে, আবার চড়ে বসে ট্রেনে। পরিচালক অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবেই ট্রেনকে এখানে সিম্বলিক করে তোলেন, কারণ এই ছবি আসলে অভিযানের গল্প, যেখানে অন্তিম গন্তব্যটা মুখ্য নয়, ঠিক জীবনের মতো। স্মৃতি, সত্তা আর পারস্পরিকতাকে সঙ্গে নিয়ে বয়ে চলা, চাইলেও থামানো সম্ভব নয়। একইরকমভাবে এই দুই চরিত্র সম্মুখীন হ্য় অনেক বাধা, ক্রূরতা, প্রগাঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সাহচর্যের, জীবনের বহু বৈপরীত্যের মতোই। এক ট্রাক ড্রাইভারের হাতে ধর্ষিত হয় কিশোরী ভউলা। তার কোমল পা বেয়ে নেমে আসা রক্তের শ্রোত স্তব্ধ করে দেয়। শিল্পী অ্যাঞ্জেলোপোলস মেলোড্রামার পরিবর্তে শুধু ব্যবহার করেন হিমশীতল নৈঃশব্দ, কোনভাবেই এই সাবপ্লটকে মুখ্য বা দীর্ঘায়িত করেন না। বরং দমকা হাওয়ার মতো নিয়ে আসেন অরেস্টিসকে। সেই যুবক এক ভ্রাম্যমান নাট্যদলের কর্মী, শখ বিসর্জন দিয়ে যে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চলেছে। এখানে পরিচালক তাঁর পূর্ববর্তী ছবি “The Travelling Players” (১৯৭৫)-এর প্রসঙ্গ আনেন, যা এই দলটিকে নিয়েই, কিন্তু এখানে তারা সস্তা বিনোদনের করাল গ্রাসে আরও দুর্দশাগ্রস্ত। এই অরেস্টিসই যেন অনিশ্চিত যাত্রাপথে আলোকস্তম্ভ। অনেকটা মুশকিল-আসানের মতোই স্তূপীকৃত জঞ্জাল থেকে সে একটি ফিল্ম নেগেটিভ তুলে ধরে ভউলা ও আলেকজান্দ্রোস তথা দর্শকের সামনে। সেখানে দেখা যায় কুয়াশায় ঢাকা এক প্রান্তর, যা কিছুক্ষণ বাদে অন্তিম দৃশ্যের প্রেক্ষাপট হয়ে উঠবে।

অসাধারণ নৈপুণ্যে অ্যাঞ্জেলোপোলস এবং টোনিনো গেরা নির্মাণ করেন নন-লিনিয়ার চিত্রনাট্যের কাঠামো। মধ্যস্থলে ফিল্ম নেগেটিভের অবতারণা এবং চলচ্চিত্রটির নিজেরই সেই দৃশ্য হয়ে ওঠা বা শিশু আলেকজান্দ্রোসের সামনে এসে এক ভায়োলিনবাদকের ছবিটির থিম মিউজিক বাজিয়ে যাওয়া তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সর্বোপরি এক অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে, অরেস্টিস ও দুই ভাইবোনের চোখের সামনে ভূমধ্যসাগরের গর্ভ থেকে একটি হেলিকপ্টার তুলে নিয়ে যায় এক অতিকায় ঐতিহাসিক প্রস্তরনির্মীত হাত, যার তর্জনী ভাঙা! দিকনির্দেশকারী সেই অনুপস্থিত আঙ্গুল যেন দিগভ্রান্ত এই দুই শিশু-কিশোরীর ট্র্যাজিক অবস্থার সংকেতবাহী। প্রসঙ্গত বলে রাখি ফেদেরিকো ফেলিনির “La Dolce Vita” (১৯৬০)-এ  সিনেমার ইতিহাসের একটি আইকনিক সিন রয়েছে, যেখানে উৎপাটিত যীশুখ্রীষ্টের একটি মূর্তি একইভাবে একটি হেলিকপ্টার নিয়ে যায়। দুটি দৃশ্যের মধ্যে অদ্ভূত সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

এই ছবি কখনই সম্ভব হত না গিওরগস কারভান্তিসের কাব্যিক সিনেমাটোগ্রাফি ছাড়া। প্যাথোস দেখতে বোধহয় এমনই হয়। সমগ্র ফিল্মটি জুড়ে যে বিবর্ণ পান্ডুরতা, কুজ্‌ঝটিকাময় দিগন্তের আনাগোনা, নির্দেশকের মানসলোকের এইসকল দৃশ্যকল্পগুলির বাস্তব চিত্রায়নের সমস্ত প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। ন্যাচারাল লাইটিংয়ের ইমেজারিগুলির জন্যই শুধু ছবিটিকে সর্বকালের অন্যতম বলা যায়। এলেনি কারাইন্ড্রুর আবহ এই ছবির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাঁর সৃষ্ট ভায়োলিনের একক সুরদ্যোতনা যেন আরও বাড়িয়ে তোলে। ভউলার চরিত্রে তানিয়া পালাইওলগু, আলেকজান্দ্রোসের চরিত্রে মিকালিস জেকে এবং অরেস্টিসের চরিত্রে স্ট্রাটোস জরজগলু যেন সত্যিকারের তিনজন মানুষ। তাদের অবিশ্বাস্য সাবলীল উপস্থিতিতে মনে হয় তারা মোটেও অভিনেতা নয়; ছবির মধ্যেটাই আসল, আর আসল বলে পরিচিত বাইরের জীবনটাতেই তারা বোধহয় অভিনয় করে গেছে!

এই ছবির জন্য থিওডোরস ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার লায়ন পুরস্কার পান। তাঁর বহু ছবি কান চলচ্চিত্রোৎসবে ‘পাম ডে অর’-এর জন্য মনোনীতও হয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী যেসব ধ্রুপদী ছবি- করিয়েদের নাম এক লহমায় উচ্চারিত হয়, সেখানে তিনি অদ্ভুতভাবে ব্রাত্য। জানা যায় তাঁর বেশীরভাগ ছবিরই নাকি কোনো আমেরিকান থিয়েট্রিকাল রিলিজ হয়নি। সেটাই কি তাঁর এই অপ্রাপ্য অপরিচিতির কারণ? শেষ দৃশ্যে ভউলা ও আলেকজান্দ্রোস সেই প্রতীক্ষিত বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পৌঁছয়, ধূসর কুয়াশা ধীরে ধীরে অপসৃত হলে তারা একছুটে গিয়ে ফ্রেমে একা দাঁড়িয়ে থাকা এক মহীরূহকে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে। তারা কি জার্মানিতে পৌঁছে গেল? না কি স্বর্গের ইডেন উদ্যান? না কি এটা অরেস্টিসের দেখানো সেই ফিল্মস্ট্রিপের অন্তর্গত সিনেমার পরাবাস্তবতা? অনেক প্রশ্ন রয়ে গেল। কিছু ক্ষেত্রে নীরবতাই সেই সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেয়। ঠিক জীবনের মতো।

#ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

31

Unique Visitors

217251